fbpx

প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী প্রজ্ঞাপন চেয়ে সারাদেশে মানববন্ধন

সরকারের ভেতর থেকেই বিভিন্ন সময়ে বিদ্যমান কোটাব্যবস্থা সংস্কারের সুপারিশ করা হয়েছিল।

সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসি) সাম্প্রতিক দুটি বার্ষিক প্রতিবেদনেও এই সুপারিশ করা হয়। এর আগে পিএসসির উদ্যোগে করা এক গবেষণায়ও কোটা সংস্কারের পরামর্শ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু সরকার তা যথাসময়ে আমলে নেয়নি। ফলে এখন লাখ লাখ শিক্ষার্থীর আন্দোলনের চাপে তাৎক্ষণিক সমাধান খুঁজতে গিয়ে জটিল পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, প্রয়োজন অনুসারে সময়ে সময়ে কোটাব্যবস্থা সংস্কার করা হলে এমন পরিস্থিতি তৈরি হতো না। তাঁরা মনে করেন, কোটা একেবারে বাতিল না করে পরীক্ষা-নিরীক্ষার মাধ্যমে কিছু ক্ষেত্রে কোটা রাখার এখনো দরকার আছে।

কেবল বাস্তবতার নিরিখে কত পদ কোটায় থাকবে, তা নিরূপণ করতে হবে। কোটা একেবারে বাতিল করা হলে নতুন করে বৈষম্য সৃষ্টির আশঙ্কা থেকে যাবে। দেশে প্রতিবছর শিক্ষিত বেকার বাড়ছে। নতুন নতুন সরকারি-বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় হচ্ছে, কলেজেও স্নাতক (সম্মান) ও স্নাতকোত্তর কোর্স চালু হচ্ছে। এমনকি ৬৭টি মাদ্রাসায় সম্মান ও ৩০ টিতে স্নাতকোত্তর স্তরে পড়ানো হয়।

কিন্তু যে পরিমাণ ডিগ্রিধারী বের হচ্ছেন, সে পরিমাণ চাকরি নেই। আবার সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করায় সরকারি চাকরির প্রতি প্রার্থীদের আগ্রহ অনেক বেড়েছে। কিন্তু কাঙ্ক্ষিত কর্মসংস্থান না থাকা এবং কোটা নিয়ে যথাযথ তথ্যের অভাব শিক্ষিত তরুণদের রাস্তায় টেনে এনেছে। ২০১৬ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনে পিএসসি বলেছে, ‘কমিশন মনে করে, বর্তমান কোটা-সংক্রান্ত নীতিমালার প্রয়োগ অত্যন্ত জটিল, দুরূহ ও বহুমাত্রিক সীমারেখা সংশ্লিষ্ট ব্যাপার।’ ২০১৫ সালের বার্ষিক প্রতিবেদনেও প্রায় একই মতামত দেওয়া হয়েছে।

পিএসসির এসব বার্ষিক প্রতিবেদনে বলা হয়, কোটার কারণে কোনো কোনো ক্ষেত্রে উপযুক্ত প্রার্থী নির্বাচন শতভাগ নিখুঁতভাবে করা কখনো কখনো প্রায় অসম্ভব হয়ে পড়ে। এই প্রেক্ষাপটে পিএসসি কোটা পদ্ধতি সহজ করা অপরিহার্য বলে মত দেয়। এর আগেও একাধিক প্রতিবেদনে কোটা সংস্কারের কথা বলেছিল পিএসসি। ২০০৮ সালে সাবেক মন্ত্রিপরিষদ সচিব আকবর আলি খান ও সাবেক সচিব (পরে প্রধান নির্বাচন কমিশনার) কাজী রকিব উদ্দীন আহমদ বাংলাদেশের জনপ্রশাসনে কোটাব্যবস্থার ওপর গবেষণা করে তা কমানোর সুপারিশ করেন।

ওই গবেষণায় বলা হয়, অগ্রাধিকার কোটা (৫৫ %) কোনোভাবেই মেধা কোটার (৪৫ %) চেয়ে বেশি হতে পারে না। প্রতিবেদনে যোগ্য প্রার্থী না পাওয়ায় মুক্তিযোদ্ধা কোটা কমানোর পরামর্শ দেওয়া হয়। পিএসসির উদ্যোগে এই গবেষণা হলেও গত এক দশকে তা বাস্তবায়ন করা হয়নি। সরকারের দিক থেকেও এসব প্রতিবেদন কখনো আমলে নেওয়া হয়নি। তবে এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা কোটা বাতিলের যে ঘোষণা দিয়েছেন তাকে স্বাগত জানিয়েছেন আকবর আলি খান।

পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের হিসাবে, প্রতিবছর ২০ থেকে ২২ লাখ তরুণ চাকরির জন্য শ্রমবাজারে প্রবেশ করছে। ফলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষক নিয়োগ থেকে শুরু করে বিসিএস পর্যন্ত সরকারি চাকরির প্রায় সব স্তরে চাপ বাড়ছে। একেকটি চাকরির জন্য কী বিপুল প্রার্থী থাকছে তার চিত্র পাওয়া যায় বিসিএস পরীক্ষা থেকে।

গত ২৮ ফেব্রুয়ারি প্রকাশিত ৩৮ তম বিসিএসের বাছাই পরীক্ষার জন্য ৩ লাখ ৮৯ হাজার ৪৬ জন আবেদন করেছিলেন। অথচ পদ মাত্র ২ হাজার ২৪ টি। ৩৭ তম বিসিএসে ১ হাজার ২২৬টি শূন্য পদের বিপরীতে আবেদন করেছিলেন ২ লাখ ৪৩ হাজার ৪৭৬ জন। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) সর্বশেষ শ্রম শক্তি জরিপ (২০১৫-১৬) বলছে, দেশে বেকারের সংখ্যা এখন ২৫ লাখ ৯০ হাজার। আর গত জানুয়ারি মাসে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে জাতীয় সংসদে যে তথ্য দেওয়া হয়েছে তাতে, সব মিলিয়ে চাকরিযোগ্য শূন্য পদ আছে ৩ লাখ ৫৯ হাজার ২৬১টি।

কিছু কোটা প্রয়োজন

জনপ্রশাসন বিশেষজ্ঞ থেকে শুরু করে কোটাবিরোধী আন্দোলনকারী শিক্ষার্থীদের একটি অংশ বলছে, একেবারে বাতিল না করে প্রয়োজন অনুযায়ী কিছু কোটা রাখা উচিত। প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর মুক্তিযোদ্ধা কোটা বহাল রাখার দাবিতে আন্দোলনে নেমেছেন মুক্তিযোদ্ধা ও তাঁদের উত্তরসূরিরা। পিএসসির সাবেক একজন চেয়ারম্যান ও সাবেক একজন মন্ত্রিপরিষদ সচিব প্রথম আলোকে বলেন, জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের অবদান ও অবস্থান বিবেচনা করে তাঁদের জন্য বিদ্যমান কোটার হার কমিয়ে কিছু পরিমাণ রাখা যেতে পারে। সে ক্ষেত্রে পিছিয়ে থাকা গরিব মুক্তিযোদ্ধার পরিবারকে অগ্রাধিকার দিতে হবে।

নারী সংগঠনগুলো বলছে, এই মুহূর্তে নারী কোটা বাতিলের মতো আর্থসামাজিক অবস্থা তৈরি হয়নি। পিএসসির একাধিক বার্ষিক প্রতিবেদন পর্যালোচনা করেও নারী কোটার প্রয়োজনীয়তার চিত্র পাওয়া গেছে। পিএসসির গত পাঁচ বছরের প্রতিবেদন পর্যালোচনায় দেখা যায়, বিসিএস পরীক্ষার আবেদনে নারীদের অংশগ্রহণ আগের চেয়ে বেড়েছে। কিন্তু বিসিএসে নারীদের চাকরির পাওয়ার হার ধারাবাহিকভাবে কমছে। ৩৩ তম বিসিএস থেকে বিগত চারটি বিসিএসে দেখা গেছে, নারীদের চাকরি পাওয়ার হার ৩৮ দশমিক ২৬ শতাংশ থেকে কমে ২৬ দশমিক ২২ শতাংশে নেমে এসেছে। এমন পরিস্থিতিতে নারী কোটা বাতিল হয়ে গেলে নারীদের আরও পিছিয়ে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।

অন্যান্য কিছু চাকরিতেও নারীদের অগ্রাধিকারের প্রয়োজন আছে। শিশুবান্ধব চিন্তা করে ১৯৯২ সাল থেকে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ৬০ শতাংশ নারী শিক্ষক নিয়োগ করা হয়। এর সুফলও পাচ্ছে সরকার। বর্তমানে বিদ্যালয় গমন উপযোগী প্রায় শতভাগ শিশু বিদ্যালয়ে ভর্তি হচ্ছে এবং ঝরে পড়ার হার ২০ শতাংশের নিচে নেমে এসেছে। প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একাধিক কর্মকর্তা বলেছেন, এই সফলতার পেছনে নারী শিক্ষকদের বড় অবদান রয়েছে। এখন সব কোটা বাতিল হয়ে গেলে প্রাথমিক শিক্ষার ওপর বড় ধরনের নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা আছে। নার্স, ধাত্রীসহ আরও কিছু চাকরিতে নারীদের অগ্রাধিকারের প্রয়োজন আছে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধূরী প্রথম আলোকে বলেন, ঢালাও কোটার প্রয়োজন নেই। তবে পরিবেশ-পরিস্থিতি বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।

প্রয়োজন অনুযায়ী ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও প্রতিবন্ধী কোটারও প্রয়োজন আছে। প্রধানমন্ত্রীও ক্ষুদ্র জাতিসত্তা ও প্রতিবন্ধীদের জন্য বিশেষ ব্যবস্থায় নিয়োগের পক্ষে বলেছেন।

আবার পিএসসির সাবেক সদস্য ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের লোকপ্রশাসন বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক মোহাম্মদ মহব্বত খান প্রথম আলোকে বলেন, কোটা রাখাই উচিত নয়। শুধু অনগ্রসর মানুষদের জন্য বড়জোর ৫ শতাংশ কোটা রাখা যেতে পারে।

সরকারি নিয়োগে জনসংখ্যার ভিত্তিতে জেলাওয়ারি পদ বণ্টনের নিয়ম রয়েছে। বিদ্যমান নিয়মে কার্যত অগ্রসর ও বড় জেলাগুলোর প্রার্থীরাই বেশি সুবিধা পান। জেলা কোটার হার বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, জেলা কোটায় যদি মোট ১০০ জন চাকরি পান, তাহলে ঢাকা জেলার প্রার্থীরা পাবেন ৮ দশমিক ৩৬ শতাংশ, যা সব জেলার চেয়ে বেশি। অথচ শেরপুরের মানুষ শূন্য দশমিক ৯৪ শতাংশ, গাইবান্ধায় ১ দশমিক ৬৫ শতাংশ, লালমনিরহাটে শূন্য দশমিক ৮৭ শতাংশ জেলা কোটায় চাকরি পান।

গত মাসে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়-সম্পর্কিত সংসদীয় কমিটিও কোটা বাতিল নয়, সংস্কারের পক্ষে মত দিয়েছে।

প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণার পর এখন এটা কীভাবে করা যায়-এ প্রশ্নে সরকারি কর্ম কমিশনের (পিএসসির) সাবেক একজন চেয়ারম্যান প্রথম আলোকে বলেন, এখন প্রধানমন্ত্রীর ঘোষণা অনুযায়ী বিদ্যমান কোটা বাতিল হয়ে যাবে। এরপর মন্ত্রিপরিষদ সচিবের নেতৃত্বে একটি কমিটির মাধ্যমে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে সব মিলিয়ে বড়জোর ২০ শতাংশের মতো কোটা রাখা যেতে পারে। তবে কোটার বণ্টন ও প্রয়োগের প্রক্রিয়া স্বচ্ছ করতে হবে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *