ঐকমত্যে দুই কোরিয়া
উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-উন এবং দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জে-ইন ঘোষণা দিয়েছেন, কোরীয় উপদ্বীপকে পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত করতে একসঙ্গে কাজ করবেন তারা।
সেই সঙ্গে অস্ত্রের ঝনঝনানি বন্ধ করে এ বছরই একটি শান্তি চুক্তিতে সই করার জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও চীনকে সঙ্গে নিয়ে কাজ করে যাওয়ার অঙ্গীকার এসেছে দুই নেতার কাছ থেকে। দুই দেশের সীমান্তবর্তী গ্রাম পানমুনজমে শুক্রবার এক ঐতিহাসিক বৈঠকের পর কিম ও মুনের এই যৌথ ঘোষণা আসে বলে আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলোর খবর। বিবিসির খবরে বলা হয়, কোরীয় উপদ্বীপকে কীভাবে পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত করা হবে- সে বিষয়ে বিস্তারিত কিছু যৌথ ঘোষণায় আসেনি।
যৌথ ঘোষণায় আরও যা আছে
>> দুই কোরিয়া নিজেদের মধ্যে হামলা বা সামরিক কর্মকাণ্ড বন্ধ করা
>> যুদ্ধের প্রচার বন্ধ করে দুই দেশের সীমান্তের ‘ডিমিলিটারাইজড জোন’কে শান্তির অঞ্চলে পরিণত করা
>> কোরীয় উপদ্বীপের অস্থিরতা কমাতে অস্ত্র কমিয়ে আনা
>> যুদ্ধের কারণে দুই দেশে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া পরিবারগুলোর পুনর্মিলনের ব্যবস্থা করা
>> সীমান্তে সড়ক ও রেল যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন
>> আসন্ন এশিয়ান গেইমসসহ বিভিন্ন ক্রীড়া প্রযোগিতায় যৌথভাবে অংশগ্রহণ
যেভাবে হল শীর্ষ বৈঠকসহ অন্যান্য আনুষ্ঠানিকতা
শুক্রবার সকালে দুই কোরিয়ার সীমান্তবর্তী অসামরিক অঞ্চল পানমুনজমে বৈঠক হয়। দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জে-ইনের সঙ্গে হাসিমুখে করমর্দন করেন কিম জং-উন। পরে দুই নেতা বৈঠকে বসেন পানমুনজমের ‘পিস হাউস’ এ ।দীর্ঘ বিচ্ছিন্নতা, সম্পর্কের টানাপোড়েন আর উত্তেজনার অচলায়তন পেরিয়ে উত্তরের নেতা দুই দেশের মিলিটারি লাইনে পৌঁছালে দক্ষিণের নেতা মুন তাকে স্বাগত জানান। কিমের অভাবনীয় এক তাৎক্ষণিক আমন্ত্রণে মুনও সীমারেখা টপকে উত্তরের মাটিতে পা রাখেন। করমর্দনের পর কিমের হাত ধরে ফের তাকে সীমান্ত পার করে দক্ষিণে নিয়ে আসেন প্রেসিডেন্ট মুন। সামরিক কায়দায় গার্ড অব অনার দিয়ে অভিবাদন জানানো হয় উত্তরের নেতাকে।
১৯৫৩ সালে কোরিয়া যুদ্ধের অবসানের পর এই প্রথম উত্তর কোরিয়ার কোনো শীর্ষ নেতার দক্ষিণে পদার্পণ। প্রথম দফা বৈঠকের পর দুই নেতাই ভোজনের জন্য চলে যান এবং কিম কড়া পাহারার মধ্য দিয়ে লিমোজিন গাড়িতে করে উত্তরে ফিরে যান। বিকালে আবার তিনি ফিরে আসার পর দুই নেতাই সীমান্তে শান্তির প্রতীক হিসাবে একটি গাছ রোপন করেন। দুই দেশের মাটি দিয়েই গাছটি লাগিয়ে এর গোড়ায় ঢালা হয় দুই দেশেরই পানি।
এরপর চিহ্নস্বরূপ একটি পাথরের ওপর লেখা হয় দুই নেতার নাম এবং বার্তামূলক ‘শান্তি ও সমৃদ্ধির বৃক্ষ রোপন’ কথাটি। এরপর উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং-উন এবং দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জে-ইন সযত্নে তৈরি ভোজে অংশ নেন। এ ভোজে খাবারের প্রতিটি গ্রাসই ছিল প্রতীকী। কোনো খাবার এসেছে নেতাদের নিজ শহর থেকে; কোনোটার উৎস ছিল অসামরিক এলাকা, যেখানে দুই পক্ষ বৈঠকে বসছে। ভোজের পর আবার গাড়িতে করে হাত নেড়ে বিদায় জানিয়ে উত্তর কোরিয়ায় ফিরে যান কিম।
শীর্ষ সম্মেলনটি কেন গুরুত্বপূর্ণ?
এক দশকেরও বেশি সময় পর দুই কোরিয়ার নেতার মধ্যে এটিই প্রথম বৈঠক। এ বৈঠক থেকে কোরিয়া উপদ্বীপে শান্তির সম্ভাবনা জেগে উঠেছে। তাছাড়া, উত্তরের নেতা কিমের জন্য এ ধরনের বৈঠকে অংশ নেওয়াও এটিই প্রথম। বেপরোয়া মনোভাবের নেতা কিম এবারই উষ্ণ ও আন্তরিক পরিবেশে দু’দেশের শীর্ষ বৈঠকের উদ্বোধনীতে শান্তির পথে এগিয়ে যেতে খোলামেলা আলোচনার সম্ভাবনা নিয়ে আশা প্রকাশ করেছেন।
তিনি বলেন, “শান্তি, সমৃদ্ধি আর আন্তঃকোরিয়া সম্পর্কের এক নতুন ইতিহাস লেখা হবে” এমন এক বিন্দু থেকেই মুনের সঙ্গে তার যাত্রা শুরু হল বলে বোধ করছেন তিনি। দুই কোরীয় নেতার এ বৈঠক থেকে আগামী দিনগুলোতে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গে উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের বৈঠকের আগে শান্তির পরিবেশ সৃষ্টি হবে বলে হোয়াইট হাউজও আশাবাদী হয়ে উঠেছে।
ঐতিহাসিক বৈঠকের পথে যেভাবে এগুলো দুই কোরিয়া
২০১৬-১৭ সাল জুড়ে একের পর এক পারমাণবিক অস্ত্র ও ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালানো এবং হম্বিতম্বি করে আসা উত্তর কোরিয়ার নেতার সঙ্গে দক্ষিণের নেতার এমন ঐতিহাসিক বৈঠক হওয়ার কথা কেউ তেমন কল্পনাও করতে পারেনি। কিন্তু জানুয়ারিতে উত্তরের নেতা কিম দক্ষিণ কোরিয়ার সঙ্গে খোলাখুলি সংলাপে বসার আগ্রহ প্রকাশ করলে দুপক্ষের মধ্যে পুনর্মিলনের সম্ভাবনা জেগে ওঠে।
পরের মাসেই শীতকালীন অলিম্পিকে দুই কোরিয়ার ক্রীড়াবিদরা এক পতাকাতলে হেঁটে নজির সৃষ্টি করেন। পিয়ংইয়ংকে পারমাণবিক অস্ত্র পরিহার করতে চুক্তিতে রাজি করানো কঠিন হবে বলে সিউল সতর্ক করে আসলেও কিম গত সপ্তাহে বলে বসেন, তিনি পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষা স্থগিত করছেন। চীনা বিশেষজ্ঞদের ধারণা, উত্তর কোরিয়ার অস্ত্র পরীক্ষাস্থলে পাথর ধসের কারণে সেটি ব্যবহারের অযোগ্য হয়ে পড়েছে।
তবে উত্তরের নেতা কিম নতুন করে কূটনৈতিক পথে অগ্রসর হওয়ার যে অদম্য ইচ্ছা দেখিয়েছেন তা পরিস্থিতির মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছে। মার্চে দক্ষিণ কোরিয়ার ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠক করেছেন তিনি। আর এরপরই কিম মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের সঙ্গেও বৈঠক করতে চান বলে ঘোষণা এসেছে।